১৪ ভুবনের বাতি প্রদানের তাৎপর্য ও গুরুত্ব
“১৪ ভুবনের বাতি প্রদানের” প্রথাটি বাংলার সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে। এই প্রথা মূলত হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে পালিত হয় এবং এর পেছনে রয়েছে আলোর মাধ্যমে পুরো জগতকে আলোকিত করার প্রতীকী অভিব্যক্তি। এখানে “১৪ ভুবন” বলতে হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী ১৪টি স্তরের জগতকে বোঝানো হয়েছে, যার মধ্যে সাতটি ঊর্ধ্বলোকে (স্বর্গ) এবং সাতটি অধঃস্থলোকে (পাতাল) বিভক্ত। এই স্তরগুলো প্রতীকী অর্থে মানুষ ও প্রকৃতির বিভিন্ন স্তরের ইঙ্গিত বহন করে।
১৪ ভুবনের বাতি প্রজ্বলনের মূল তাৎপর্য হলো সমগ্র জগৎ, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক ও পার্থিব সমস্ত স্তরের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা। এতে এই বিশ্বাস নিহিত রয়েছে যে, আলো অন্ধকারকে দূর করে সবার মাঝে শুভ শক্তির প্রসার ঘটায়। এটি আত্মার আলোর প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, যা অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলো ছড়াতে সহায়তা করে।
অনুষ্ঠানে ১৪টি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবতা ও পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়, যা মূলত ব্যক্তির পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উন্নতি কামনা করে।
সনাতন শাস্ত্রে তথা হিন্দু শাস্ত্রে ১৪ ভুবনের ধারণা উল্লেখ রয়েছে, যা সমগ্র সৃষ্টির বিভিন্ন স্তরকে নির্দেশ করে। এগুলি সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত: সাতটি ঊর্ধ্বভূবন (স্বর্গীয় স্তর) এবং সাতটি অধঃভুবন (পাতালীয় স্তর)। প্রতিটি স্তর আলাদা আলাদা আধ্যাত্মিক এবং প্রতীকী অর্থ বহন করে। নিচে ১৪টি ভুবনের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো:
ঊর্ধ্বভূবন (স্বর্গীয় স্তর):
১. সত্যলোক: এটিকে ব্রহ্মলোকও বলা হয় এবং এটি সকল ঊর্ধ্বভুবনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এখানে ব্রহ্মা অবস্থান করেন এবং এটি আধ্যাত্মিক সিদ্ধির চূড়ান্ত স্তর বলে বিবেচিত।
২. তপঃলোক: এটি মুনিগণের জন্য নির্ধারিত স্থান, যেখানে তাঁরা কঠোর তপস্যার মাধ্যমে আত্মজ্ঞান ও সৃষ্টির গূঢ় সত্য জানতে চেষ্টা করেন। মুনিরা এখানে মোক্ষ লাভের জন্য সাধনা করেন।
৩। জনলোক: এখানে ঋষিরা অবস্থান করেন, বিশেষত তাঁরা যাঁরা আধ্যাত্মিকভাবে অনেক উচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছেন। এখানে সাধনা ও জ্ঞানের মাধ্যমে সৃষ্টির মূল প্রকৃতি বোঝা হয়।
৪। মহার্লোক: এই স্তরে মহর্ষিগণ বা মহান ঋষিরা অবস্থান করেন। এটি একটি উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক অবস্থান, যেখানে জ্ঞানের সাধনা এবং সৃষ্টির গূঢ় সত্যকে উপলব্ধি করা যায়।
৫। স্বর্গলোক: এটি দেবতাদের স্থান এবং দেবরাজ ইন্দ্রের অধীন। স্বর্গলোক সুখ, শান্তি এবং বিলাসিতার স্থান হিসেবে পরিচিত এবং এখানে সৎকর্মের ফল ভোগ করা হয়।
৬। ভুবর্লোক: এই স্তরটি মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এটি একটি মধ্যবর্তী স্তর, যেখানে মানবজীবন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন শক্তির প্রভাব বিদ্যমান।
৭। ভূলোক: এটি আমাদের পৃথিবী। এখানে মানুষ বসবাস করে এবং এটি সুখ, দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু, কর্মফল ও পুনর্জন্মের স্থান।
অধঃভুবন (পাতালীয় স্তর):
৮। অতল: এটি একটি গভীর স্থান, যেখানে মায়া ও ইন্দ্রিয়সুখে পূর্ণ শক্তি ও রত্নের ভাণ্ডার বিদ্যমান বলে মনে করা হয়। এখানে বিষধর সর্প এবং মায়াময় জীবরা বাস করে।
৯। বিতল: এখানে বৃহৎ নেগ বা সর্পজাতীয় প্রাণীরা বাস করে। এটি দানবীয় শক্তি এবং মায়া দ্বারা পূর্ণ এক স্তর বলে বিবেচিত।
১০। সুতল: এখানে দানব ও দৈত্যদের রাজা মহাবলি বাস করেন। এটি একটি শান্তিপূর্ণ স্তর, যেখানে মহাবলির রাজত্ব শুদ্ধ ও উন্নত বলে ধরা হয়।
১১। তলাতল: এখানে মায়াবী শক্তির অধিকারী রাক্ষসেরা বাস করে এবং এখানে মূলত অশুভ শক্তির উপস্থিতি বিদ্যমান।
১২। মহাতল: এখানে বিশাল সর্প এবং নাগেরা বাস করে, যারা নিজেদের বিষাক্ত শক্তির জন্য বিখ্যাত। এরা শক্তিশালী এবং সাধারণত শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৩। রাসাতল: এটি একটি আরও গভীর স্তর, যেখানে রাক্ষসেরা থাকে এবং এরা সাধারণত দেবতাদের শত্রু বলে বিবেচিত। এদের মধ্যে বিভিন্ন মায়াবী ক্ষমতা ও ধ্বংসাত্মক শক্তি রয়েছে।
১৪। পাতাল: এটি সর্বনিম্ন স্তর এবং এখানে নাগরাজ বাস করে। এখানে বাসিন্দারা ইন্দ্রিয়সুখে লিপ্ত থাকে এবং এদের জীবন অত্যন্ত বিলাসবহুল বলে ধরা হয়।
এই ১৪টি ভুবন হিন্দু শাস্ত্রে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা আমাদের মানসিক, আধ্যাত্মিক, এবং পার্থিব স্তরের ধারণা দিতে সহায়ক।